প্রথম অধ্যায় যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি Introduction to Logic যুক্তিবিদ্যা । প্রথম পত্র ১.১ যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

প্রথম অধ্যায় যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি Introduction to Logic যুক্তিবিদ্যা । প্রথম পত্র ১.১ যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

প্রথম অধ্যায়

যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি

Introduction to Logic

গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪ – খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২) থেকে যুক্তিবিদ্যার যাত্রা শুরু। যুক্তিবিদ্যা জ্ঞানের অন্যতম মৌলিক শাখা। দার্শনিক চিন্তার বিকাশের কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও চিন্তার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো জানা বিষয় থেকে অজানা বিষয়ে গমন করে কোনো বিষয়ের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা, ধারণা দেওয়া, সত্যকে অনুসন্ধান করা, যুক্তির কলা-কৌশলকে তুলে ধরা, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে সহায়তা করা, দৃষ্টিভঙ্গির সম্প্রসারণ করা, সুচিন্তিত যুক্তিবিন্যাস উন্মোচন করাই হলো যুক্তিবিদ্যার প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী। সর্বদাই সে অভিনবত্বের সন্ধান করে বেড়ায়। সঠিকভাবে, সুনিপুণরূপে যুক্তি প্রদান এবং অযথার্থ যুক্তিকে পরিহার বা বর্জন করে চিন্তাকে পরিশীলিত ও গঠনমূলক করার ক্ষেত্রে যুক্তিবিদ্যার ভূমিকা অনন্য। মানুষের মধ্যে যে বুদ্ধি, বিবেক ও বিচারশক্তি রয়েছে সেগুলোর শানিত রূপ তাদের অদম্য কৌতূহলকে নিবৃত্ত করে। যুক্তিবিদ্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষকে জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করে এবং পদার্থিক ও অতি প্রাকৃত জগৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ও পরিষ্কার ধারণা দেয়। যুক্তিবিদ্যা তার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, প্রকৃতি ও স্বরূপ এবং পরিধি ও পরিসরের মধ্য দিয়ে মানুষের বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ ঘটায় এবং বৈধ যুক্তি উপস্থাপন করে অবৈধ যুক্তি বর্জন করার ক্ষেত্র তৈরি করে।



যুক্তিবিদ্যা । প্রথম পত্র



১.১ যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

Origin and Development of Logic

 

দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দর্শনের তিনটি শাখা- জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা ও মূল্যবিদ্যা। এর মধ্যে মূল্যবিদ্যার কাজ হলো সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আদর্শের প্রেক্ষিতে বিষয়বস্তুকে মূল্যায়ন করা। যুক্তিবিদ্যা এই মূল্যবিদ্যার একটি বিশেষ শাখা। এদিক থেকে যুক্তিবিদ্যাকে দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বলে মনে করা হয়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার প্রথম আচার্য বা শিক্ষক। তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেন বিচারমূলক চিন্তা পদ্ধতি নিয়ে একটি বিশিষ্ট বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু গড়ে উঠতে পারে। তিনি তাঁর পূর্বসূরি সক্রেটিস ও প্লেটো-এর উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন নি। এজন্য স্বাভাবিকভাবে এরিস্টটলকে যুক্তিবিদ্যার জনক বলা হয়। মূলত তাঁর সময়কাল থেকেই যুক্তিবিদ্যা নানারকম পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বিরামহীনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে, অগ্রগতির দিকে অনবরত বিকশিত হচ্ছে। এ পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন দার্শনিক ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে যুক্তিবিদ্যা নানাত্মবে উপস্থাপিত হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে যুক্তিবিদ্যার স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য, আলোচ্য বিষয় ও পরিসর সম্পর্কে পারস্পরিক ভিন্নমত সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে এরিস্টটল ও মধ্যযুগীয় তার্কিক সম্প্রদায়ের নীতিসমূহের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যুক্তিবিদ্যা। তবে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা যুক্তিবিদ্যার গুরুত্বকে খাটো করে নি, বরং যুগে যুগে নিত্য নতুন ধ্যান-ধারণার সাথে সাথে যুক্তিবিদ্যা তার শাশ্বত ঐতিহ্য ও গুরুত্বকে জ্ঞানানুরাগীদের কাছে তুলে ধরেছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের উপর চিন্তা করে। এ চিন্তাকে পুনরায় ভাষায় প্রকাশ করে তাকে সামজিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে রূপান্তরিত করে। ব্যক্তির চিন্তা ভাষায় প্রকাশিত হলেই সেটি যুক্তিবিদ্যার আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন সময়ে যুক্তিবিদ্যার বিকাশে এ কথাটিই বিধৃত হয়। যুক্তিবিদ্যার সূত্রপাত ঘটে একটি যুক্তিবাক্যের সাথে আরেকটি যুক্তিবাক্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণে। বাক্যের সাথে বাক্যের সম্পর্ক কত প্রকারের হতে পারে, বাক্যের অংশসমূহের বৈশিষ্ট্য কী, বাক্যের পারম্পর্য কিভাবে রক্ষিত হতে পায়ে এ সমস্ত বিষয় নিয়ে যুক্তিবিদ্যা তার ক্রমবিকাশের ধারা অটুট রেখেছে। পর্যবেক্ষণ, তুলনা, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, সংজ্ঞা, পরীক্ষা, হেত্বাভাষ বা ত্রুটি, যুক্তির বিকৃতি; যুক্তির অপপ্রয়োগ সকল ক্ষেত্রে সকল সময়ে যুক্তিবিদ্যার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের সাথে এ বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে যুক্তির দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। যথা: অবরোহ ও আরোহ। অবরোহ প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট যুক্তির শুরুতে প্রদত্ত এক বা একাধিক বাক্যের ভিত্তিতে একটি অনিবার্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আরোহ যুক্তিতে বাস্তব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বাস্তবক্ষেত্রে সম্ভাব্য একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুক্তিবিদ্যার ক্রমবিকাশের ধারায় দেখা যায় সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি। অবরোহ যুক্তির সিদ্ধান্তের সত্যতা যুক্তির শুরুতে গৃহীত যুক্তিবাক্যের সত্যতা ও অসত্যতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আরোহ। যুক্তির সিদ্ধারের সত্যতা নির্ভর করে বাস্তব পর্যবেক্ষণের সঠিকতার উপর। অবরোহ ও আরোহ পরস্পর পরিপূরক পদ্ধতি।



যুক্তিবিদ্যার ইতিহাস থেকে জানা যায় ইংরেজি 'Logic শব্দটি গ্রিক শব্দ Logike' থেকে এসেছে। 'Logike' শব্দটি 'Logos' শব্দের বিশেষণ। Logos শব্দের অর্থ চিন্তা, শব্দ বা ভাষা। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার জনক। তাঁর দার্শনিক চিন্তার মধ্য দিয়ে যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ। এজন্য এরিস্টটল প্রদত্ত যুক্তিবিদ্যাকে বলা হয় এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা বা সনাতনী যুক্তিবিদ্যা বা সাবেকী যুক্তিবিদ্যা। এ যুক্তিবিদ্যার আরেক নাম অবরোহ যুক্তিবিদ্যা। জানা থেকে অজানায়, জ্ঞাত থেকে অজ্ঞাতে যাওয়ার প্রক্রিয়া ছিল অবরোহভিত্তিক। যুক্তিচিন্তনের এরিস্টটলীয় যুগে বলা হতো জানা থেকে অজানার দিকে

এগিয়ে যাওয়াই ছিল জ্ঞানের অগ্রগতি এবং বিশুদ্ধ জ্ঞানের ভিত্তি। এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে গড়ে উঠেছে আধুনিক ও প্রতীকী যুক্তিবিদ্যা এবং আরোহ যুক্তিবিদ্যা। জ্ঞান বিকাশের চিন্তাধারা বাস্তব ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক হওয়ায় আরোহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়। তবে যুক্তিবিদ্যার মৌলিক দিক বিচার ও বিশ্লেষণ করলে স্বতঃসিদ্ধ ও প্রামাণিক সত্য হিসেবে আমরা এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যাকেই যুক্তিচিন্তনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তর বা সোপান হিসেবে স্বীকার করে। নিই। এ স্বীকার্যমূলক যুক্তিচিন্তন প্রক্রিয়া উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে জেভঙ্গ, অলড্রিচ, হোয়েটলি, টমসন, ওয়েলটন, হ্যামিলটন, জে. এস. মিল, যোসেফ এবং আই. এম. কপি'র মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করে।



পূর্বে ধারণা করা হতো অবরোহ ও আরোহ ব্যতীত যুক্তির আর কোনো পদ্ধতি নেই। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে দার্শনিক জর্জ বুল যুক্তির ক্ষেত্রে আঙ্কিক ও প্রতীক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে বার্ট্রান্ড রাসেল ও হোয়াইটহেড এই পদ্ধতিকে অধিকতর ব্যাপক হারে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। যুক্তির এই আধুনিক বিকাশকে আঙ্কিক যুক্তি, প্রতীক যুক্তি বা যুক্তির বীজগণিতীয় বলে আখ্যায়িত করা হয়। আঙ্কিক যুক্তি জটিল বলে মনে হলেও সাধারণীকরণের ক্ষেত্রে যে গভীর তাৎপর্য রয়েছে, তা নিচের উদাহরণ থেকে বুঝা যায়।

 

সকল মানুষ হয় মরণশীল।

রাসেল হন একজন মানুষ।

রাসেল হন মরণশীল।

 

এই দৃষ্টান্তের অনিবার্যের যে সত্যতা রয়েছে তা থেকে আমরা বলতে পারি ।

 

সকল ক হচ্ছে খ

সকল গ হচ্ছে ক

সকল গ হচ্ছে খ

আবার এ সত্যকে আকিকভাবে আমরা বলতে পারি যে,

 

 A = B, C = A

C=B

 

যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ থেকে দেখা যায় যে, অতি অল্প লোকই যুক্তিবিদ্যা পড়তে চায়। কারণ প্রত্যেকেই মনে করে ইতিমধ্যেই সে যুক্তিতে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। যুক্তিক্রিয়া ভালো হয় যদি তার মাধ্যমে সত্য হেতুবচন থেকে সত্য সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়; নইলে তা ভালো নয়। যুক্তিবিদ্যার ইতিহাসে ‘যুক্তিবিদ্যা' শব্দটা দুজন স্বতন্ত্র দার্শনিক কখনো এক অর্থে ব্যবহার করেন না। মধ্যযুগ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত যুক্তিবিদ্যাকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ‘ন্যায়ানুমানের নিয়মাবলির বিজ্ঞান' বলা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু থেকে যেসব দার্শনিক অনুমান নিয়ে কাজ করেছেন তাদের সকলেই মধ্যযুগীয় ভাবধারা বর্জন করেছেন। তারা কোনো না কোনোভাবে যুক্তিবিদ্যার পরিধিকে প্রসারিত করেছেন। যুক্তিবিদ্যার এ প্রসারণ হচ্ছে বেকন ও গ্যালিলিও কর্তৃক আরোহী পদ্ধতির প্রবর্তন। হেগেল সেখানে নির্বিচারীভাবে গতানুগতিক যুক্তিবিদ্যাকে আগে থেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দিকে যুক্তিবিদ্যার কৌশলগত উন্নয়ন ঘটেছে। সেটি হলো যুক্তিবিদ্যাকে গাণিতিক বিজ্ঞান বলা হয়। যুক্তিবিদ্যা দুই অর্থে গাণিতিক। এক অর্থে যুক্তিবিদ্যাকে গণিতের একটি শাখা, অন্য অর্থে গণিতের অন্যান্য শাখাতে যুক্তিবিদ্যার নিয়মাবলি প্রযোজ্য। তক যুক্তিবিদ্যার আধুনিক বিকাশ শুরু হয় বুলের 'Laws of Thought' (১৮৫৪)-এর সময় থেকে। আধুনিক যুক্তিবিদ্যা আমাদের অমূর্ত কল্পনার প্রসার ঘটিয়েছে। ক্লাসিক্যাল ধারায় যে যুক্তিবিদ্যার চর্চা করা হয়, আধুনিক যুক্তিবিদ্যা ঠিক তার বিপরীত। প্রাচীন যুক্তিবিদ্যা চিন্তার পায়ে শিকল পরিয়েছিল। আধুনিক যুক্তিবিদ্যা তাকে ডানা দিয়েছে। পদার্থবিদ্যায় গ্যালিলিও যে অগ্রগতি সাধন করেছিল, আধুনিক যুক্তিবিদ্যা দর্শনে তাই করেছে। কাজেই যুক্তিবিদ্যার প্রধান ভূমিকা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রমাণের মূল্যায়ন। জ্ঞান অর্জনের জন্য মানুষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের উপর চিন্তা করে। এ কারণে চিন্তার ভাষায় প্রকাশিত রূপ হচ্ছে যুক্তিবিদ্যার বিচার্য বিষয়, যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে জ্ঞানানুসন্ধানের তত্ত্ব। নির্ভরযোগ্য জ্ঞান আহরণের বিভিন্ন পদ্ধতির আলোচনা দিয়েই যুক্তিবিদ্যার পরিমণ্ডল গঠিত।

 

দলীয় কাজ : শ্রেণিশিক্ষকের সহায়তায় বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ধারা উপস্থাপন কর।

 


Akul Vai

25 Blog posts

Comments